ভারতবর্ষ তার ধার্মিক সুখ্যাতির জন্য বিশ্বে প্রসিদ্ধ । ধর্ম , ভক্তি ও বিভিন্ন চমৎকারে লীলাক্ষেত্র আমাদের দেশ। বিশ্বাসেই মেলে ভগবান। এখানে এমন অনেক মন্দির আছে যার রহস্য উদ্ঘাটন করা বিজ্ঞানীদের পক্ষেও সম্ভব নয় । এখানেই বিষ্ণু অবতীর্ণ হন কৃষ্ণ রূপে । এখানেই ঘটে সাইবাবার অলৌকিক লীলা। এখানেই রামকৃষ্ণর দর্শন হয় মা কালীর । হিন্দিতে একটি প্রবাদ আছে ‘ মন হ চঙ্গা, ত কঠতি উথ গঙ্গা ‘। ভারতের মন্দিরে মন্দিরে লুকিয়ে আছে এমনি অনেক রহস্য ।
কামরূপ কামাখ্যা
উত্তর পূর্ব ভারতের আসামের গুয়াহাটির নিকট নীলাচল পাহাড়ে কামাখ্যা মন্দির অবস্থিত । পুরানে কথিত আছে মহাদেব যখন মা সতীর মৃতদেহ কাধে নিয়ে তাণ্ডব করছিলেন তখন বিষ্ণু নিজের চক্র দিয়ে মা সতীর দেহ খণ্ড বিখণ্ড করেন । মা সতীর দেহ খণ্ড যেখানে যেখানে পরে সেইসব স্থান গুলি শক্তিপীঠ হয়ে উঠে । তার মধ্যে প্রসিদ্ধ কামরূপ কামাখ্যা । এখানে দেবীর যোনি দেশ পড়েছিল । যোনিদেশ পড়েই পাথরে রুপান্তরিত হয়েছে । এই পাথরই দেবী কামাখ্যা । দেবীর কোন মূর্তি নেই । দেবীর অধিষ্ঠান যোনি গহ্বরে।
কথিত আছে কেউ যদি এই শিলা স্পর্শ করে তাহলে দেবত্ব লাভ করে । নিল্কুট পাহাড়ের উপর যেখানে দেবীর যোনি দেশ পরেছিল তার নাম কুজিকা। এই মন্দিরে আশ্চর্য চমৎকার হয় আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষের অম্বাবুচির সময় । তিন দিন ধরে মেলা চলে কামাখ্যায় । তিন দিন ধরে বন্ধ থাকে মার মন্দির । ঐ সময় মার যোনি দেশ থেকে রক্তক্ষরণ হয় । লাল কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকে ঐ স্থান । আরও আশ্চর্য ব্যাপার হল মন্দিরের দরজা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায় ঐ সময় । এই মন্দিরে সবার কামনা পূরণ হয় তাই এই মন্দিরের নাম কামরূপ কামাখ্যা ।
করনি মাতা মন্দির
ভারতের উত্তর প্রান্তে রাজস্থান সংস্কৃতি ও ধার্মিক আস্থার নগরী । বিকানের থেকে ৩০ কিলি মিটার দূরে দেশনক শহরে কারনি মাতার মন্দির অবস্থিত । রাজস্থানের একটি প্রসিদ্ধ তীর্থ স্থান । এই মন্দিরের দর্শনার্থীরা মার দর্শনএর সাথে হাজার হাজার ইদুরের দর্শন পান । অতি আশ্চর্য জনক দৃশ্য । মন্দিরের চারিদিকে হাজার হাজার ইঁদুরের সমাগম । দর্শনার্থীরা মার পূজার জন্য ভোগ ও ইঁদুরদের জন্য লাড্ডু ও দুধ নিয়ে আসে । দু রঙের ইঁদুর দেখা যায় ।বেশির ভাগ কালো ইঁদুর দেখা যায় তবে সাদা ইঁদুরের দর্শন পাওয়া খুব বিরল । কথিত আছে সাদা ইঁদুরের দর্শন যে পায় তার মনকামনা পূরণ হয় । কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায় এত ইঁদুর কোথা থেকে আসে ।
কথিত আছে কারনি মাতা ১৪৪৪ সালে ৭ আশ্বিন মাসে কৃষ্ণ পক্ষে আবির্ভূত হন । বলা হয় মা দুর্গার প্রতিরূপ মা কারনি দেবী । মা যে গুহায় ধ্যান মগ্ন হতেন সেখানে ওনার শরির যতীর লিঙ্গ রূপে অধিষ্ঠান হয় । এখন ঐ স্থান মার মন্দির । কারনি মাতার বিবাহ হয় দেকাজির সাথে । কিন্তু মা কুমারী হয়েই থাকেন । মার মর্জিতেই ছোট বোন বাইর সাথে ওনার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে হয় । তারপর মার ছোট বোনের চার সন্তানের জন্ম দেন । মা যখন ধ্যান মগ্ন হতেন এই সন্তানেরা মার সেবা করতেন । আজও এই পরম্পরা চলে আসছে । এই জন্য তাদের বারিদার বলা হয় । ইঁদুর নিয়ে একটি কাহিনী কথিত আছে । মার ছোট বোনের ছোট সন্তানের নাম ছিল লক্ষণ রাজ । মার সবচাইতে প্রিয় পুত্র ছিল। কিন্তু কুয়ায় পরে তার মৃত্যু হয় । মা তপস্যা করে যমের কাছ থেকে তার প্রাণ ফিরিয়ে দিতে বল্লেন । যম লক্ষণের প্রাণ ফেরত দিল কিন্তু মনুষ্য রূপে নয় ইঁদুর রূপে । কথিত আছে মা কারনির বংশজ মৃত্যুর পর ইঁদুর রূপে জন্ম গ্রহন করে এই মন্দিরে থেকে যায় । এত ইঁদুর থাকা সত্যে ও এই মন্দিরের প্রসাদ খেয়ে কারোর কোনোদিন ক্ষতি হয় নি । এই ইদুরেরা মন্দির প্রাঙ্গন ছেড়ে বাইরে কোন দিন বের হয় না। এরা দর্শনার্থীদের কোন ক্ষতি করে না । যদি কোন ইঁদুর কারোর পায়ের উপর দিয়ে যায় তাহলে সেটা শুভ সংকেত মানা হয় ।
মেহেন্দিপুর বালাজি মন্দির
রাজস্থানের তসার জেলায় অবস্থিত মেহেন্দিপুর বালাজি মন্দির । এই মন্দিরে এমন কিছু রহস্য আছে যার ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিকের কাছে ও নেই । এই মন্দিরে পূজিত বালাজি মহারাজ হলেন রাম ভক্ত হনুমানজি । ওনার সঙ্গে আছেন প্রেত রাজ সরকার ও কোতওয়াল ভৈরব । প্রেত রাজা ভুতদের দণ্ড দেন । ভৈরব মহাদেবের আরেক রুপ । কথিত আছে প্রেত রাজা ও বালাজি মহারাজ আরাবল্লি পর্বতে প্রকট হয়েছেন ভূত , পিশাচ ও ব্ল্যাক মেজিকের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে । ভূত পিশাচ আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ করে তোলেন এই মন্দিরের পুরোহিতেরা। এই মন্দিরে প্রবেশ করলে এমন কিছু দৃশ্য চোখে পরে যা দেখে আত্মা কেপে উঠে । কোন মানুষকে যখন অশুভ শক্তি নিজের বশে করে নেয় তখন তাদের এই মন্দিরে নিয়ে আসা হয় । মন্দির প্রাঙ্গনে ঢুকতেই তাদের বীভৎস চীৎকার শুরু হয় এবং তারা আপনা আপনি তাদের ভিতরের অশুভ শক্তির কথা বলতে থাকে । এই দৃশ্য অত্যন্ত ভয়াবহ ।
কিছু মানুষদের শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয় । আরও আশ্চর্য ব্যাপার হল যখন মন্দিরে সকাল সন্ধায় আরতি শুরু হয় তখন অশরীরী আক্রান্ত মানুষেরা এসে জড়ো হয় । যাদের শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয় তারা আপনা আপনি উল্টো হয়ে ঝুলে যায় । রোগী যদি মহিলা হয় তিনি উলটে থাকা সত্যেও তার শরীরের কাপড় উল্টোয় না । বালাজি মহারাজের পূজার পর দুটি লাড্ডু প্রসাদ রূপে দেওয়া হয় ঐ প্রসাদ রোগীকে খাওয়ানো হয় । তারা সুস্থ হয়ে আপনা আপনি বালাজি মহারাজের জয় বলতে থাকে । হানুমান চালিশার একটি লাইন মনে পরে গেল “ ভূত পিশাচ নিকট নাহি আবে , মাহাবির যব নাম শুনাবে “ । এই মন্দিরে আস্তে হলে মাছ ,মাংস, মদ্যপান, পেয়াজ ও রসুন খাওয়া যায় না । স্থানীয়দের কথায় বাড়ি থেকে বেরবার আগে বালাজি মহা রাজের কাছে প্রার্থনা করতে হয় যাতে দর্শনার্থী সুস্থ শরীরে বাবার দর্শন পায় । ঠিক একইভাবে বাড়ি ফেরার জন্যও, তারপর এক মুহূর্ত ঐ জায়গায় থাকতে নেই। সাধারণত আমরা পুজ করে বাড়ি প্রসাদ নিয়ে আসি । কিন্তু এই মন্দিরে ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো , বাবার মন্দিরের প্রসাদ সেখানেই খেয়ে আসতে হয় এবং যদি কিছু প্রসাদ বাকি থাকে তা মন্দিরের বাইরে পশু- পাখিদের দিয়ে দিতে হয় । এমনকি সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ক্রিম ও পাউডার পর্যন্ত বাড়ি ফেরত আনতে নেই । আরেকটি প্রয়োজনীয় তথ্য এই মন্দির সম্পর্কে এই মন্দিরে প্রবেশ করার পর কেউ যদি পিছন থেকে ডাকে তাহলে পিছন ফিরে তাকাতে নেই । কারন সেই ডাক কোন পরিজনের নয় অতৃপ্ত আত্মাদের । অশুভ শক্তি সবসময় কাউকে না কাউকে বশ করার জন্য উদবিগ্ন হয়ে থাকে ।
কাল ভৈরব মন্দির
মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত উজ্জয়িনি শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে কাল ভৈরব মন্দির অবস্থিত । পুরানে কথিত আছে মহাদেবের রক্ত থেকে ভৈরব এর জন্ম । এই রক্ত দুটি ভাগে বিভক্ত হয় । একজন বটুক ভৈরব এবং অন্যজন কাল ভৈরব । বটুক ভৈরব মহাদেবের বাল্যরূপ । কাল ভৈরব মহাদেবের যুবকরূপ । ব্রহ্মদেবের অহঙ্কার মোচনের জন্য কাল ভৈরব ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তিস্ক ছেদন করেন । তখন বাবার উপর ব্রহ্মহত্যার পাপ লাগে । তার প্রায়শ্চিত্ত করতে তিনি অবন্তিকায় আসেন । শিপ্রা নদীতে স্নান করে তপস্যায় বসেন । তারপর মহাদেবের ব্রহ্মহত্যা থকে মুক্তি পান ।এই স্থান পরবর্তী কালে কাল ভৈরব মন্দির হয় । এই মন্দিরের চমৎকার হল কালভৈরবকে ভোগ হিসাবে দর্শনার্থীরা মদ অর্পণ করে ।
বাবা ঐ মদ পান করেন ।কি করে এটা সম্ভব এক মাত্র ভৈরবনাথ জানেন । ভৈরবনাথকে যখন ভোগ নিবেদন করা হয় তখন তিনি ঐ মদ পান করেন । কথিত আছে নিবেদিত ভোগকে বিশেষ ভাবে মন্ত্রপূত করা হয় । তারপর বাবাকে পান করান হয় । কথিত আছে ভৈরবনাথ যদি মদ পান করেন তাহলে দর্শনার্থীর মনবাসনা পূর্ণ হয় ।
শনির দশা থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র উপায় এই কা ভৈরব -এর পূজা । যেভাবে সব দেবতাদের পূজার দিন নিশ্চিত থাকে সেভাবে ভৈরবনাথের পূজার দিন রবিবার ও মঙ্গল বার । কাল ভৈরব -এর এই মন্দিরকে তান্ত্রিক পীঠও বলা হয় । ভৈরবনাথ প্রতি বিশ্বাসই দর্শনার্থীদের টেনে নিয়ে আসে এই মন্দিরে ।
কন্যা কুমারী দেবী মন্দির
দক্ষিণ ভারতের কন্যা কুমারীতে তিনটি সমুদ্রের মিলন স্থলে মা পার্বতীর এই মন্দির অবস্থিত । এখানে মা পার্বতীর কুমারি রূপে বিরাজমান । আরব সাগর , বঙ্গপোসাগর ও ভারত সাগরের মিলন স্থলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় ।এই মন্দিরে পুরুষ দর্শনার্থীদের কোমর থেকে উপরের বস্ত্র ত্যাগ করে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয় । পুরানে কথিত আছে মা পার্বতী দেবাদিদেব মহাদেবকে স্বামী রূপে পাওয়ার জন্য এখানে তপস্যা করেন । মহাদেব মার তপস্যা প্রসন্ন হয়ে মা পার্বতীকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন । কিন্তু এদিকে বানাসুর নামে এক অসুর দেবতা ও মর্তবাসিদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে, ব্রহ্মার বর অনুযায়ী একমাত্র কুমারি নারী তাকে সংহার করতে পারবে । অন্যদিকে মার বিবাহের আয়োজন চলছে । কিন্তু এই বিবাহ হলে বানাসুরকে সংহার করা সম্ভব নয় । তাই দেবতারা নারদ মুনির পরামর্শে বিবাহের সময় নির্ধারণ করেন । শেষ রাত্রে বিবাহের সময় নির্ধারণ করা হয় । মহাদেব সময় অনুযায়ী দেবীকে বিবাহের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেন । যখন তিনি বাল্যকাপুরম পৌঁছান তখন নারদ মুনি এক মোরগের বেশ ধরে উচ্চস্বরে চিৎকার শুরু করেন। ঐ আওয়াজ শুনে মহাদেব ভগ্ন হৃদয়ে চলে যান । তখন মা পণ করেন তিনি চিরকুমারী হয়ে থাকবেন। বিবাহের জন্য যে চাল ও ডাল আনা হয়েছিল তা এই সমুদ্র তটে ফেলে দেওয়া হয় । পরে এই চাল ডাল কাঁকড়ে রূপান্তরিত হয় ।
আজও এই সমুদ্র তটে চাল ও ডালের আকারে ছোট ছোট পাথর দেখা যায় । দেবীর নামেই এই স্থানের নাম কন্যাকুমারী । এই দিব্য কাহিনীর সাক্ষী হয়ে আছে এই সমুদ্র তট ।